ঢাকা ২৯ অক্টোবর, ২০২৫
সংবাদ শিরোনাম
ডেঙ্গুতে মারা গেলেন তিনবারের বিশ্বজয়ী হাফেজ ত্বকী আশুলিয়ার ভাদাইল ফ্রেন্ড ক্লাবের উদ্যোগে ফুটপাত ও হকারমুক্ত করায় স্বস্তিতে লাখো শ্রমিক ভৈরবে সড়ক-রেল-নৌপথ অবরোধের ঘোষণা ক্যাসিনো সম্রাটের সাজা ঘোষণা আইডিয়াল কলেজ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ, সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ বেসরকারি চাকরিজীবীদের বেতন নিয়ে বড় সুখবর জুলাই সনদ বাস্তবায়নের সুপারিশ প্রধান উপদেষ্টার কাছে হস্তান্তর বিপুল সংখ্যক জামিন দেওয়ায় হাইকোর্টের ৩ বিচারপতির কাছে ব্যাখ্যা তলব ভোটের আগে অধিকাংশ অস্ত্র উদ্ধার হবে: স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার ফিরলেও আগামী নির্বাচন হবে অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনেই’

সংক্রমণ ৫৩% বৃদ্ধি, শঙ্কার মাস শুরু

#

০৪ অক্টোবর, ২০২৫,  11:58 AM

news image

ডেঙ্গুর সংক্রমণ বেড়েই চলেছে। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আক্রান্তের সংখ্যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় বেড়েছে প্রায় ৫৩ শতাংশ। একই সঙ্গে মৃত্যু বেড়েছে ১৬ দশমিক ৯৫ শতাংশ। শুধু তাই নয়, এই রোগে মোট মৃত্যুর ৬০ শতাংশ রোগী চিকিৎসাধীন ছিলেন রাজধানীর সরকারি ছয় হাসপাতালে। 

তবে জেলা পর্যায়ে জটিল রোগী ব্যবস্থাপনা না থাকায় ঢাকার হাসপাতালে রোগীর চাপ বাড়ছে। জনস্বাস্থ্যের এমন সমস্যা নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে। তাদের আশঙ্কা, চলতি মাসে পরিস্থিতি আরও গুরুতর হতে পারে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এখনই কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার তাগিদ দিয়েছেন তারা।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, গত জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৪৭ হাজার ৩৪২ জন আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন, যা গত বছরের তুলনায় রোগী হার ৫৩ শতাংশ। গত বছর এই সময়ে মোট রোগীর সংখ্যা ছিল ৩০ হাজার ৯৩৪ জন।

এ বছর সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ১৮৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। গত বছর একই সময়ে এই সংখ্যা ছিল ১৬৩ জন। সেই হিসাবে মৃত্যুর হার বেড়েছে ১৫ দশমিক ৯৫ শতাংশ। ২০২৩ সালে জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৯ মাসে ডেঙ্গু নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন দুই লাখ তিন হাজার ৪০৬ জন এবং মৃত্যু হয় ৯৪৯ জনের। ২০২২ সালে ভর্তি ছিলেন ১৪ হাজার ১২০ জন। ওই বছরের ৯ মাসে মৃত্যু হয় ৫৫ জনের।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, চলতি বছর ৩ অক্টোবর পর্যন্ত ৪৮ হাজার ৪৯১ জনের শরীরে ডেঙ্গু ভাইরাস শনাক্ত হয়েছে। মারা গেছেন ২০২ জন। 

এদের মধ্যে ১২২ জন চিকিৎসাধীন ছিলেন ঢাকার দুই সিটির সরকারি হাসপাতালে, যা মোট মৃত্যুর ৬০ দশমিক ৩৯ শতাংশ। শুধু ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের হাসপাতালগুলোতে মারা গেছেন ৯৫ জন।

দেরিতে হাসপাতালে আসায় বাড়ছে জটিলতা

রাজধানীর সরকারি বড় ছয়টি হাসপাতাল রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতাল। এই হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসায় আলাদা ইউনিট রয়েছে। চলতি বছর এক হাজার ৯৯৯ ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসা এই হাসপাতালে হয়েছে। তাদের মধ্যে ৪৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। চিকিৎসা নেওয়া অধিকাংশ রোগী ছিলেন ঢাকার বাইরের।

ঢামেকের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান বলেন, অনেক রোগী গুরুতর পেট ব্যথা, শ্বাসকষ্ট, রক্তক্ষরণ, তীব্র অবসাদ, প্রস্রাবের পরিমাণ বা প্লাটিলেট দ্রুত কমে যাওয়ার মতো লক্ষণগুলো যে বড় ক্ষতির কারণ হতে পারে, সেটা বুঝতে পারছেন না। যার কারণে দেরি করে হাসপাতালে আসার পর দেখা যাচ্ছে, অনেকের অবস্থাই সংকটজনক।

ঝুঁকি এড়াতে বয়স্ক রোগী, একাধিক রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি ও সন্তানসম্ভবা নারীদের দ্রুত হাসপাতালে ভর্তির পরামর্শ দেন তিনি। পাশাপাশি সতর্ক করেন ডেঙ্গুর একাধিক ধরনে পুনঃসংক্রমণ হলে জটিলতা মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে। বিশেষ করে চিকিৎসায় দেরি হলে। জেলা পর্যায়ের হাসপাতালগুলোকে জাতীয় ডেঙ্গু চিকিৎসা নির্দেশিকা অনুসরণ করে স্থানীয়ভাবে রোগীদের চিকিৎসা দেওয়ার আহ্বান জানান। 

মো. আসাদুজ্জামান বলেন, শুধু গুরুতর রোগীদেরই ঢাকায় পাঠানো উচিত। কিন্তু প্রায়ই ভয়ের কারণে রোগীকে আগেই রেফার করা হয়।

১০ জেলায় ডেঙ্গুর প্রকোপ

এ বছর ১০ জেলায় ডেঙ্গু পরিস্থিতি ভয়াবহ আকারে দেখা দিয়েছে। এর মধ্যে সর্বোচ্চ রোগী বরগুনা। এর পরই রয়েছে ঢাকা, বরিশাল, পটুয়াখালী, পিরোজপুর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, গাজীপুর ও কুমিল্লা।

বরগুনায় আক্রান্ত সাত হাজার ৩৪১ জন, মৃত্যু ১৪ জনের। ঢাকা জেলায় (মহানগরসহ) আক্রান্ত ১৩ হাজার ১৩ জন, মৃত্যু ১২৩ জনের। বরিশালে আক্রান্ত দুই হাজার ৪৩৬, মৃত্যু ১৮ জনের। চট্টগ্রামে আক্রান্ত দুই হাজার ৩৬৯ জন, মৃত্যু ২০ জনের। পটুয়াখালীতে আক্রান্ত দুই হাজার ২২৫ জন, মৃত্যু একজনের। কুমিল্লায় আক্রান্ত এক হাজার ৫৩৬ জন, মৃত্যু তিনজনের। কক্সবাজারে আক্রান্ত ৮০৯ জন, মৃত্যু একজনের। চাঁপাইনবাবগঞ্জে আক্রান্ত এক হাজার ৪৬৫ জন, পিরোজপুরে এক হাজার ৮৫৪ এবং গাজীপুরে আক্রান্ত এক হাজার ৬৮৭ জন। এই তিন জেলায় কোনো মৃত্যু নেই।

সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) পরিচালক অধ্যাপক ডা. তাহমিনা শিরিন জানান, সুপেয় পানি সংকটের কারণে বরগুনায় বৃষ্টির পানি ধরে রাখার প্রচলন আছে। এডিস মশার লার্ভা তৈরি হয় জমিয়ে রাখা পরিষ্কার পানিতে। এসব পানির আধারই হলো এডিসের বিস্তারের বড় ক্ষেত্র। বাড়িতে রাখা প্লাস্টিকের ড্রামের পানি ঢেকে রাখা হয় কাপড় দিয়ে। এর চর্চা গ্রামে বেশি। আর এসব কাপড়ে ব্যাপক মাত্রায় লার্ভা পাওয়া গেছে বলে জানান তিনি।

১১ সিটিতে নেই কীটতত্ত্ববিদ

এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে তাদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে কীটতত্ত্ববিদরা। তবে দেশের ১২টি সিটি করপোরেশনের মধ্যে ১১টিতেই নেই কোনো কীটতত্ত্ববিদ। এডিস মশায়ই ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া ও জিকা ভাইরাস ছড়িয়ে দেয়, যা জনস্বাস্থ্যের জন্য বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেবল ২৬টি জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয়ে কীটতত্ত্ববিদের অনুমোদিত পদ রয়েছে, যার মধ্যে অন্তত ১২টি পদ ২৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত শূন্য পড়ে আছে। অথচ ডেঙ্গু এখন সারা বছরের সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

৭০ শতাংশ ডেঙ্গু সংক্রমণ ডেন-২ স্ট্রেইনে

‘সেরো-সার্ভেইল্যান্স’ হলো রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার পরিমাণ বোঝার এক ধরনের পরীক্ষা, যা সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য পদ্ধতি হিসেবে বিবেচিত। ডেঙ্গু ভাইরাসের চারটি সেরোটাইপ রয়েছে: ডেন-১, ডেন-২, ডেন-৩ ও ডেন-৪। সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) তথ্য বলছে, চলতি বছর ৭০ শতাংশ ডেঙ্গু সংক্রমণ ডেন-২ স্ট্রেইনের সঙ্গে সম্পর্কিত ছিল। বাকি ডেন-১, ডেন-৩ ও ডেন-৪ ৩০ শতাংশ আক্রান্ত। এ বছর বেশির ভাগ রোগী সেকেন্ডারি ডেঙ্গু সংক্রমণে ভুগছেন, যা আরও গুরুতর এবং এতে মৃত্যুর ঝুঁকি বেশি।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বয়স্ক ব্যক্তি, অন্তঃসত্ত্বা নারী ও তাদের মতো অন্যদের উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ রোগীদের দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে।

সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, ঢাকার বাইরে বেশ কিছুদিন ধরে রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। এর ফলে সেখানে চাপ তৈরি হচ্ছে। ঢাকার বাইরের মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলো স্বাস্থ্য বিষয়ে নির্দেশিকা ঠিকমতো পেলেও জটিল রোগীর ব্যবস্থাপনা জেলা পর্যায়ে অনেক দুর্বল। অনেক সময় চিকিৎসকরা ঝুঁকি নিতে চান না। ফলে রোগীরা নিরুপায় হয়ে ঢাকামুখী হচ্ছেন।

স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলো মশা নিধনে কতটুকু কাজ করতে পারছে, তা নিয়ে সন্দিহান এই বিশেষজ্ঞ। তিনি বলেন, ঢাকার দুই সিটিতে মশা নিয়ন্ত্রণে কিছু কার্যকর উদ্যোগ আছে; কিন্তু বাইরে তা নেই। বিশেষ করে চট্টগ্রাম ও বরিশালের পরিস্থিতির দিকে নজর দিতে হবে। সেখানে সংক্রমণ প্রতিদিন বাড়ছে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালেয়র প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও কীটতত্ত্ববিদ অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার বলেন, অক্টোবরে সম্ভাব্য ভয়াবহ ডেঙ্গু পরিস্থিতি এড়াতে হলে এখনই কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। দেরি হলে কেবল মৃত্যুর মিছিলই দীর্ঘ হবে না, দেশের অর্থনীতিও ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। 

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. আবু জাফর বলেন, পরিস্থিতি ক্রমেই উদ্বেগজনক হয়ে উঠছে। অধিকাংশ রোগী হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার দুই থেকে তিন দিনের মধ্যেই মারা যাচ্ছেন। সর্বাধিক মৃত্যু ঘটছে ২০ থেকে ৩০ বছর বয়সী রোগীদের মধ্যে। তাদের অনেকেই জ্বর শুরু হওয়ার ছয় থেকে সাত দিন পর চিকিৎসা নিতে আসেন, যা অনেক সময় জটিলতা এড়ানোর জন্য দেরি হয়ে যায়। শিশুদের মধ্যেও মৃত্যুঝুঁকি বেড়েছে। ডেঙ্গুতে মৃত্যুঝুঁকি মোকাবিলায় সময়মতো চিকিৎসা নেওয়া অত্যন্ত জরুরি। সূত্র : সমকাল


logo

সম্পাদক ও প্রকাশক : মো. নজরুল ইসলাম